বাহাসের মধ্যে রাজনীতি হঠাৎ জিয়ার লাশ বিতর্ক
রাজনীতিতে খরা চলছে করোনাকালের আগে থেকেই। শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে না উঠে বিরোধী দলগুলো এক ধরনের রণে ভঙ্গ দিয়েছে বলেই মনে হয়। গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতি মূলত সীমাবদ্ধ আছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতাদের বাহাসের মধ্যে। অন্য দলগুলোর তৎপরতাও মিডিয়া-নির্ভর। আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষ মুখে আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলে কিন্তু মাঠে নামার সাহস দেখাতে পারে না। তাদের অভিযোগ, সরকার এবং সরকারি দল মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দৌঁড়ের মধ্যে রেখেছে। হামলা-মামলার ভয়ে বিরোধী নেতাকর্মীরা আতঙ্কে থাকে সারাক্ষণ। প্রশ্ন হলো, সরকার পরিস্থিতি তৈরি করে দেবে, নাকি বিরোধী দল নিজেদের শক্তি সংহত করে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করবে? আসলে আমাদের দেশে রাজনীতিতে যে শূন্যতা এবং স্থবিরতা চলছে তা কীভাবে দূর হবে তা কোনো পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ সেভাবে বলতে পারছেন না। এক সময় ঝড়ে বক মরলে হয়তো ফকিরের কেরামতির বিষয়টি সামনে আসবে। আগস্ট মাস এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি যেমন আলোচনায় আসে, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় জিয়াউর রহমান এবং অন্য নেপথ্য শক্তির বিষয়ও উত্থাপিত হয়। কিন্তু সবই অভিযোগ আকারে এবং তথ্য-প্রমাণের চেয়ে নিজ নিজ পক্ষের সুবিধা অনুযায়ী টার্গেট ঠিক করে অভিযোগের তির ছোঁড়া হয়। এবারও সে রকমই হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুকে যারা প্রত্যক্ষভাবে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের মদদ ছিল। আবার, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার অনুসারী বলে পরিচিত খোন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ায় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। এই বিতর্কের অবসান সহসা হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতি মোটাদাগে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শিবিরে বিভক্ত। কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির একমত হওয়ার সুযোগ দেখা যায় না। একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য দুই দলই মুখিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ মনে করে, দেশের সব খারাপের গোড়া হলো বিএনপি আর বিএনপি মনে করে আওয়ামী লীগই সব মন্দের মূল। গত ২৬ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সভায় দলীয় সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কিছু কথা বলেছেন, যা বিএনপির পক্ষে সহজে হজম করা কঠিন। অবশ্য এমন অভিযোগ শেখ হাসিনা এই প্রথম করলেন তা নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার জড়িত থাকার কথা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ছোটবড় নেতারা প্রায়ই বলেন। এবারও বলেছেন। এবার আবার বহুদিন পর সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার যে কবর সেখানে জিয়ার লাশ আছে কিনা সে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৭ আগস্ট জিয়ার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হলে, পুলিশ বাধ্য হয়ে ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের কথাও জানানো হয়। তবে বিএনপির অভিযোগ, পুলিশ উস্কানিমূলক আচরণ করেছে। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জিয়ার কবরে গিয়ে মারামারি করলো বিএনপি, তারা জানে না, সেখানে জিয়ার কবর নাই, জিয়া নাই ওখানে, জিয়ার লাশ নাই? তারা তা ভালোই জানে। তাহলে এত নাটক কেন? প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের মুখ থেকেই শুনেছেন, কফিনে যিনি ছিলেন তার কমব্যাট ড্রেস পরা ছিল। জিয়াউর রহমান তখন কমব্যাট ড্রেস পরে না। এটা কি বিএনপির নেতারা জানে না?’ শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেছেন, ‘খালেদা জিয়া, তার দুই পুত্র কি লাশ দেখেছিল? ছবি দেখেছে কখনো? ওখানে লাশই ছিল না।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন অভিযোগের পর বিএনপির পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব নয়। কারণ জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি বিএনপির রাজনীতির বড় পুঁজি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ দাফন করা হয়েছিল। এটা তো চাঁদের আলোর মতো পরিষ্কার। এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু হতে পারে না। কারণ তৎকালীন সেনা অধিনায়ক জেনারেল এরশাদ নিজেই জিয়াউর রহমানের লাশ বহন করেছেন। ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চট্টগ্রাম থেকে যখন জিয়াউর রহমানের দেহ তোলা হয়, তারপর তার ময়নাতদন্ত করা হয়। ডা. তোফায়েল আহমেদ তার মরদেহের পোস্টমর্টেম করেছিলেন। ২২ টি বুলেট তার শরীর থেকে বের করা হয়েছিল। এখানে কিছু মিসিং পয়েন্ট আছে। এটা জানা যে, ১৯৮০ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। সেখান থেকে তার লাশ আনুমানিক ৪০/৫০ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়ায় নিয়ে প্রথমে সমাহিত করা হয়েছিল। তারপর সেখান থেকে দেহাবশেষ তুলে এনে চন্দ্রিমা উদ্যানে সমাহিত করা হয়েছিল। জিয়ার কফিন ঢাকা আনার পর সমাহিত করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সেটা ছিল বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন (এবং লিখেছেন) ঢাকায় আনার পর কফিন কেউ খোলেননি। ওখানে জিয়ার মরদেহ ছিল এটা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। রাঙ্গুনিয়ার কবর থেকে যারা দেহাবশেষ তুলেছিলেন, তাদের কাছে মোহাম্মদ আলী সিকদার জেনেছিলেন যে, ওই কবরে একসঙ্গে তিনজনকে সমাহিত করা হয়েছিল। কবর থেকে তোলার পর কাউকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা অসম্ভব ছিল। লাশগুলো এতটাই ক্ষতবিক্ষত ছিল যে কার লাশ কোনটি তা বোঝার উপায় ছিল না। ফলে ওই কফিনে জিয়ার লাশ ছিল কিনা তা নিশ্চিন্ত করে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। জিয়া নিহত হওয়ার পর সার্কিট হাউজ থেকে মরদেহ রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ে কে বা কারা নিয়ে গিয়েছিল, সেটাও কি কেউ বলতে পারবে? জেনারেল এরশাদ কফিন বহন করেছিলেন, কিন্তু ভেতরে জিয়ার লাশ ছিল কিনা সেটা তিনি কখনো বলেননি। এই বিতর্কে অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ৩০ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করি, সেখানে (কবরে) জিয়ার লাশ নাই। ডিএনএ টেস্ট করে যদি জিয়ার কবরে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তাহলে আমি নাকে খত দিয়ে ক্ষমা চাইবো'। বিএনপির কেউ পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বিষয়টির একটি নিষ্পত্তির দিকে যাবে কিনা বলা কঠিন। লাশ বিতর্ক শেষ হলে আমাদের রাজনীতির একটি ইস্যু কমে যেতে পারে। ইস্যু শেষ নয়, তৈরি করাই তো রাজনীতিবিদদের একটি প্রিয় কাজ! তবে এটা ঠিক, সংসদ ভবনের সামনে জিয়াউর রহমানের জানাজায় বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। যদিও এমন প্রচারও আছে যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাদা পোশাকে সামরিক বাহিনীর লোকজনকে জানাজায় উপস্থিত করে মানুষের উপস্থিতি বেশি দেখানো হয়েছিল। চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরের বিষয়টি জিয়াভক্তদের বিশ্বাস এবং আবেগের সঙ্গে জড়িত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে সমাহিত করার বিষয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই, প্রশ্ন নেই। কারণ তার লাশ গোসল করানোসহ জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের বিস্তারিত বয়ান আছে। কিন্তু জিয়ার লাশ কে বা কারা গোসল করিয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃতদেহের ছবি সবাই দেখেছে। জিয়ার মৃতদেহের কোনো ছবি নেই। কিন্তু জিয়া আছেন তার সমর্থকদের অন্তরে, বিশ্বাসে। জিয়াকে নিয়ে তার মৃত্যুর পর নানা ধরনের মিথ্যা বা কল্পগল্প তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু তার ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ পর্যন্ত প্রায় সবই ছিল অস্বচ্ছ এবং অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেহেতু তার একটি বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরির একটি সচেতন চেষ্টা ছিল তাদের, যারা আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর বিকল্প একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম চেয়েছিলেন। জিয়ার সততার কাহিনী বলতে গিয়ে মৃত্যুর পর ভাঙ্গা সুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জির গল্পও ফাঁদা হয়েছিল। অথচ প্রকৃত অর্থে তিনি কপর্দকহীন ছিলেন না। তার এবং তার স্ত্রীর জীবনযাপনে কোনো কৃচ্ছসাধনের বালাই ছিল না। যত যাই বলা হোক না কেন, জিয়াউর রহমানের প্রতি তার সমর্থকদের আস্থা টলবে না। মৃত্যুর এত বছর পর কবরে তার লাশ আছে কিনা সেই বিতর্ক তুলে আওয়ামী লীগের কোনো বাড়তি ফায়দা হবে বলে মনে হয় না। বিএনপি বা জিয়াউর রহমানকে যারা সমর্থন করেন তারা যুক্তিবাদী হলে দেশের রাজনীতির বর্তমান হাল হতো না। খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন বানিয়েও মানুষের কাছ থেকে নিন্দার বদলে প্রশংসাই পেয়েছেন। চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে জিয়া না থাকলেও বিএনপি সমর্থকরা সেখানে যাওয়া বন্ধ করবে না। তবে সেখান থেকে কবর সরালে কি হবে তা বলা মুশকিল। ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে খালেদা জিয়াকে বের করলে আওয়ামী লীগের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে বাড়ি থেকে বের হয়ে খালেদা জিয়ার যে চোখের পানি ফেলেছেন, তা রুমালেই মুছতে হয়েছে। আর বেশি কিছু হয়নি। এখন লাশ বিতর্ক রাজনীতি নতুন কোনো মাত্রা যোগ করে কিনা দেখার অপেক্ষা সেটাই। লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক